১.
ইরানে পার্সি ক্যালেন্ডার অনুসারে নববর্ষের ১৩তম দিনে আনন্দ মজা করা হয়। এই দিন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ১লা এপ্রিল ও ২রা এপ্রিল সদৃশ্য। ঐতিহাসিকদের মতে, ১৫৬৪ সালে ফ্রান্সে নতুন ক্যালেন্ডার চালু করাকে কেন্দ্র করে এপ্রিল ফুল ডে'র সুচনা হয়। ঐ ক্যালেন্ডারে ১লা এপ্রিলের পরিবর্তে ১লা জানুয়ারীকে নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে গণনার সিদ্ধান্ত নেয়া হলে কিছু লোক তার বিরোধিতা করে। যারা পুরনো ক্যালেণ্ডার অনুযায়ী ১লা এপ্রিলকেই নববর্ষের ১ম দিন ধরে দিন গণনা করে আসছিল, তাদেরকে প্রতি বছর ১লা এপ্রিলে বোকা উপাধি দেয়া হতো। ফ্রান্সে পয়সন দ্য আভ্রিল(poisson d'avril) পালিত হয় এবং এর সাথে সম্পর্ক আছে মাছের। এপ্রিলের শুরুর দিকে ডিম ফুটে মাছের বাচ্চা বের হয়। এই শিশু মাছগুলোকে সহজে বোকা বানিয়ে ধরা যায়। সেজন্য তারা ১ এপ্রিল পালন করে পয়সন দ্য এভ্রিল অর্থাৎ এপ্রিলের মাছ। সে দিন বাচ্চারা অন্য বাচ্চাদের পিঠে কাগজের মাছ ঝুলিয়ে দেয় তাদের অজান্তে। যখন অন্যরা দেখে তখন বলে ওঠে পয়সন দ্য আভ্রিল বলে চিৎকার করে। কবি চসারের ক্যান্টারবারি টেইলস(১৩৯২) বইয়ের নানস প্রিস্টস টেইল এ এই দিনের কথা খুজে পাওয়া যায়। (উইকিপিডিয়া)
২.
কোনো একটি সংস্কৃতির একটি নির্দিষ্ট উত্সব বা একক রীতি থেকে আধুনিক ‘এপ্রিল ফুল’ শুরু হয়েছিল বলে মনে করেন না অনেক ইতিহাস গবেষকই। প্রাচীনকাল থেকেই সাম্রাজ্য ও ধর্ম বিস্তার এবং ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে একদিকে যেমন ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে আদান-প্রদান বেড়েছে, তেমনি নানান জাতিগোষ্ঠীর ওপর ভিন্ন সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা করা হয়েছে। আবার প্রতিক্রিয়া হিসেবে পালটা বা প্রতিরোধী সংস্কৃতিরও জন্ম দিয়েছে নানান সময়ের নানান জাতি-জনগোষ্ঠী। কালের বিবর্তনে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির ভিন্ন মাত্রার নানান উপাদানও একত্রে মিশে যেতে পারে। কালে কালে রূপ বদলাতে পারে আচার-অনুষ্ঠান উত্সবের। এপ্রিল ফুল উদযাপনের বিষয়টিও তেমনি নানাভাবে আবর্তিত-বিবর্তিত হয়ে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে বলে মনে করা হয়। (প্রথম আরো, ১লা এপ্রিল ২০১৪)
৩.
মুহাম্মদ আবদুল কাহহার : বাংলাদেশ ৯০ শতাংশ মুসলিমের দেশ হলেও আমরা মুসলিমরা আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, চরিত্র, ধর্ম ও সংস্কৃতি সবকিছুই যেন ভুলে গেছি! মুসলিম হিসেবে কী করণীয় তা খুঁজে দেখি না। এক কথায় বিবেকের দায়বদ্ধতা নেই বললেই চলে। জ্ঞান চর্চা না করে চরিত্রহীনদের অনুকরণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। তার একটি দৃষ্টান্ত হলো ‘এপ্রিল ফুল’ উদযাপন করা। এপ্রিল ফুল শব্দের অর্থ, দিবসের সূচনাকাল, প্রেক্ষাপট, মুসলিমদের সাথে এ দিবসের সম্পর্ক ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক, দিবসে কী কী করা হয়, করণীয়-বর্জনীয় ও তথ্যের ভিত্তিসহ নানা দিক আমাদের জানা দরকার। এসব কিছু জানার পর তা মেনে চলাই জ্ঞানীর কাজ।
এ দিবসের প্রেক্ষাপট না জেনেই এর চর্চা করা হচ্ছে। নিজেরা যেমন এ অপসংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে পড়ছি তেমনি আমাদের সন্তানরাও অজ্ঞতাবশত এ দিবসকে পালন করছে। এপ্রিল ফুল দিবসের ইতিহাস যারা জানেন তারা এ দিবসটি পালন করেন না বরং এ রকম একটি দিবস পালনকে বড় ধরনের অন্যায় বলে স্বীকার করেন।
এবারে মূল কথায় আসা যাক। সাংস্কৃতিক কর্ম হিসেবে কৌতুক করেই পালন করা হয় এপ্রিল মাসের প্রথম দিনটি। এ দিবসটি এপ্রিল ফুল নামে পরিচিত। এর অন্য নাম হলো অখখ ঋঙঙখঝ’উঅণ। ফুল (ঋড়ড়ষ) একটি ইংরেজি শব্দ। এর অর্থ বোকা। ইংরেজি এপ্রিল ফুলের অর্থ এপ্রিলের বোকা। স্পেনের তৎকালীন খ্রিস্টানরা মুসলিমদের বোকা বানিয়েছে বলেই নামটি এ রকম। এপ্রিল ফুল সম্পর্কে কয়েকটি বর্ণনা পাওয়া যায়। পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথার প্রচলন থাকলেও সত্যকে কেউ অস্বীকার করতে পারে না। মুসলিমপিডিয়া, জুইস এনসাইক্লোপিডিয়া ও অন্যান্য এনসাইক্লোপিডিয়া ও ইতিহাস গ্রন্থের বরাতে ড. আবু বকর মুহাম্মদ যাকারিয়া সম্পাদিত ‘পহেলা এপ্রিল’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, স্পেনের অত্যাচারিত মানুষদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুসলিম বাহিনী ৯২ হিজরি মুতাবেক ৭১১ খ্রি. স্পেনে প্রবেশ করে। মুসলিমগণই ইউরোপের মানুষদের জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষা দেন। মুসলিম স্পেনের গ্রানাডা, কর্ডোভা ও অন্যান্য শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা পড়তে আসত। ৭১১-১৪৯২ খ্রি. পর্যন্ত প্রায় আটশ বছর স্পেন, ফ্রান্স ও পর্তুগাল মুসলমানরা শাসন করেছিল। এটি ছিল মুসলমানদের জন্য স্বর্ণযুগ। শেষ দিকে তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ছড়িয়ে পড়ে। মুসলিমরা কুরআন-সুন্নাহ ভুলে গিয়ে দুনিয়ার মায়ায় মত্ত হয়ে নেতার নির্দেশ অমান্য করায় পারস্পরিক শত্রুতা বেড়ে গেল। তখনই তারা স্পেন ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। ফলে খ্রিস্টানরা ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন অঞ্চল মুসলিমদের থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়।
আজ থেকে ৫২২ বছর আগে মুসলিম অধ্যুষিত ৮৯৮ হিজরি মোতাবেক ১৪৯৩ খ্রি. রাজা ফার্দিনান্ড ও রানী ঈসাবেলার যৌথ উদ্যোগে মুসলিমদের শেষ রাজধানী গ্রানাডা দখল করতে সক্ষম হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, চিকিৎসা, রাজনীতি, স্থাপত্য, শিল্প ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দেখে মুসলমানদের ক্ষতি করার জন্য রাজা ফার্দিনান্ড এক ভয়ঙ্কর ফন্দি আঁটলো। মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হলো। মুসলমানরা রাজা-রানীর কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। এমতাবস্থায় ফার্দিনান্ড ঘোষণা করেছিল, যারা মসজিদে গিয়ে আশ্রয় নেবে তাদের নিরাপদে আশ্রয় দেওয়া হবে। তার ঘোষণায় চল্লিশ হাজার মুসলমান আত্মবিশ্বাসী হয়ে গ্রানাডার বিভিন্ন মসজিদে আশ্রয় নিলেও তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। মসজিদের দরজাগুলো বাহির থেকে বন্ধ করে দিয়ে মসজিদের মেঝেতে পেট্রল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে মুসলিমদের হত্যা করেছিল রাজা ফার্দিনান্ড। ঐতিহাসিক এক বর্ণনা মতে তিন দিন পর্যন্ত হত্যার উৎসব চলেছিল। মসজিদের বাহিরেও অসংখ্য মুসলিমকে আগুনে পুড়িয়ে, পাহাড় থেকে ফেলে, সমুদ্রের মধ্যে জাহাজ ডুবিয়ে ও গণজবাই করে হত্যা করা হয়। অনেককে জোর করে ধর্মান্তরিত করা হয়। অথচ মুসলমানরা এ রকম একটি অবস্থার জন্য প্রস্তুত না থাকায় তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেদিন খ্রিস্টানগুরুর আদেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল সূত্র লক্ষ লক্ষ আরবি পুস্তক পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়। শুধু মুসলিমগণ নয়, ইয়াহুদীদের উপরও খ্রিস্টানগণ একই রূপ অত্যাচার করে।
এ সময়ে রাজা ফার্দিনান্ড উপহাস করে বলেছিল, হায় মুসলমান! তোমরা হলে এপ্রিলের বোকা। মুসলিমদের মিথ্যা আশ্বাসের মাধ্যমে বোকা বানানোর সময়কে স্মরণীয় করে রাখতে এপ্রিল ফুল পালন করা হয়। অবশেষে খ্রিস্টানরা কর্ডোভার সেই ঐতিহাসিক মসজিদটিকে গীর্জায় পরিণত করেছে। মসজিদের ভেতরে দরজা ও জানালার ফাঁকে ফাঁকে মূর্তি স্থাপন করেছে। এভাবেই মুসলিম ঐতিহ্যকে ধ্বংস করা হয়েছে। এ ঘটনা ছাড়া আরো দুটি ঘটনার কথা উইকিপিডিয়াতে উল্লেখ থাকলেও বর্ণিত ঘটনাটিই সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ বলে ঐতিহাসিকরা মত প্রকাশ করেছেন। (দৈনিক ইনকিলাব, ২৮/৩/২০১৫)
৪.
উপরের খণ্ড খণ্ড লিখাগুলো হতে অন্তত এতটুকুই পরিস্কার যে, এই দিবসটি মানুষের সাথে মিথ্যা আচরণ, ধোকা দেওয়া ও প্রতারণা মতো নোংরা ও জঘন্য কাজ চর্চা করার শিক্ষা দেয় এবং এতে আনন্দ খুঁজে পেতে উৎসাহ দেয় । যদিও এই আনন্দ হয় একপাক্ষিক । কারণ অপরপক্ষ এই আচরণে রীতিমতো বিরক্ত ও রাগান্বিতই হয় । তাই এসব আচরণকে ন্যুনতম জ্ঞানসম্পন্ন কোন মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় গ্রহণ করে না । তবে বোকা আর মূর্খদের বিষয় আলাদা । কারণ তারা তো একপ্রকার জ্ঞানশূন্য প্রাণীই ।
৫.
যেহেতু পৃথিবীর আদিলগ্ন থেকে শত শত মানুষের হাতে গড়া জীবনব্যবস্থার বিপরীতে আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন আল ইসলাম লড়ে আসছে, সেহেতু সত্যের খুঁজে ঐ একমাত্র সফল ধর্মটির নিকট ফিরে যাওয়াই বাঞ্চনীয় । আর এই সত্যের রেখা ধরেই এইসব অনাচার ও অপসংস্কৃতিকে বর্জন করা সম্ভব । তাই এই বিষয়ে ইসলামের কিছু সতর্কবার্তা নিচে উল্লেখ করেই শেষ করছি-
একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাবারের এক স্তুপের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তিনি খাবারের স্তুপে হাত প্রবেশ করালেন, তার আঙুলগুলো ভিজে গেল। তাই তিনি বললেন, ‘হে খাবারওয়ালা, এটা কি ? সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, তাতে বৃষ্টির পানি পড়েছিল। তিনি বললেন, তুমি কি তা খাবারের উপরে রাখতে পারলে না, যাতে মানুষ তা দেখে ? যে প্রতারণা করে, সে আমার দলভুক্ত নয়।’ অন্য রেওয়ায়েতে আছে ‘যে আমাদের সাথে প্রতারণার আশ্রয় নেয়, সে আমাদের দলভুক্ত নয়’। অপর রেওয়ায়েতে আছে ‘সে আমাদের দলভুক্ত নয়, যে প্রতারণার আশ্রয় নেয়।’ (মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেন: 'চরম সর্বনাশ ঐ ব্যক্তির জন্য যে মানুষকে হাসানোর উদ্দেশ্যে মিথ্যা কথা বলে থাকে । তার জন্য সর্বনাশ, তার জন্য সর্বনাশ ।' (তিরমিযীঃ ২৩১৫; আবু দাউদঃ ৪৯৯০)
রাসূলুল্লাহ (সা:) আরও বলেন: ‘যে ব্যক্তি যে জাতির অনুকরণ করবে, সে ব্যক্তি সেই জাতিরই একজন বলে গণ্য হবে’ (আবূ দাঊদঃ ৪০৩১)
সবিশেষে একটা প্রশ্ন সৃষ্টি হয়- "আপনি কি মিল্লাতে ইবরাহীমের (ইসলামের) উপর থাকতে চান নাকি অন্য (ভ্রান্ত) কিছু খুঁজছেন?"
তবে কেবল বোকারাই ভ্রান্তি আর ভ্রষ্টতার পিছনে ছুটে ।
আল্লাহ্ আমাদেরকে মিল্লাতে ইবরাহীমের (ইসলামের) উপর রাখুন । আমীন ।
#সংগৃহীত
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন