খুব জরুরী কাজে কিছুদিন গ্রামে ছিলাম। প্রথম প্রথম গ্রামীন পরিবেশ দেখে খুব ভাল লাগলো। মসজিদ ভরা মানুষ (এমনকি ফজরেও), প্রায় সব পরিবারেই সিস্টারদের মধ্যে হিজাবের প্রচলন। কিন্তু একটা ব্যাপারে এসে দিলটা আটকে গেল, মনটা খারাপ হয়ে গেল। জানিনা এটাকে আমরা কবে শুধরাতে পারবো। মনে করেন, কোন এক তাহাজ্জুদ পড়নেওয়ালা বুজুর্গ ‘ক’ বিয়ে করে নতুন একটা ভিটায় গেল। তার ৩ টা ছেলে ৪ টা মেয়ে হল। সাত ভাইবোন একসাথে বড় হল এবং পরবর্তীতে তার ৪ মেয়ে বিয়ে হয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। ৩ ছেলে ‘এ’, ‘বি’ এবং ‘সি’ বাড়িতে রয়ে গেল । পরবর্তীতে এই তিন ছেলে বিয়ে করে একই ভিটায় রয়ে গেল। এখন এই ৩ ছেলের প্রত্যেকের ২ টা করে ছেলে আর ২ টা করে মেয়ে হল । মানে মোট ছেলে মেয়ে হল ৬ + ৬ = ১২ জন। এখন এই ১২ জন ছেলে মেয়ে হল বুজুর্গ ‘ক’ এর নাতি-নাতনী।
এই বুজুর্গ ‘ক’ এর নাতনীরা (৬ জন) অতি বুজুর্গ, তাঁরা সব সময় যেখানেই যান, হিজাব করে যান। সমস্যার শুরুটা এখানেই। তাহাজ্জুদ পড়নেওয়ালা বুজুর্গ ‘ক’ এটা চিন্তা করতে ভুলে যান, যে তাঁর ফার্স্ট ডিসেন্ডেন্টস ৭ জন ভাই বোন আসলে আপন ভাই বোন, তাঁদের মধ্যে কোন পর্দা/হিজাব নাই: সুতরাং এক সাথে এঁরা বড় হতে পারেন। কিন্তু তাঁর সেকেন্ড ডিসেন্ডেন্টস অতি প্রাণপ্রিয় ৬ জন নাতনীকে তাঁর অতিপ্রিয় ৬ নাতির সাথে আসলে হিজাব করতে হবে এবং এরা আসলে একে অপরের নন- মাহরাম। কারণ তারা আসলে চাচত ভাই-বোন, আপন ভাই বোন নন। এঁরা (নাতি এবং নাতনীরা) এক সাথে বড় হলে অসুবিধা আছে। এক ভাই ‘এ’ এর পুত্রের সাথে অপর ভাই ‘বি’ এর কন্যার বিয়ে আসলে বৈধ। মানে এক ভাই এর পুত্রের সাথে অপর ভাই এর কন্যাদের তাঁরা একসাথে একই ভিটায় বড় হতে পারবেন না, কারণ এক ভিটায় বড় হলে নাতনীদেরকে সারাদিন ঘরের মধ্যে পর্দা করতে হবে; যেটা সম্ভব না, আর কেউ তা করেও না। কারণ ঘুম থেকে উঠলেই আপনার সাথে আপনার চাচত(ভাই/বোন) এর দেখা হয়ে যাবে যদি আপনারা এক ভিটায় থাকেন। আরও একটা সমস্যা আছে, সেটা হল: ‘এ’, ‘বি’ এবং ‘সি’ এই তিন ভাইর বউদেরকে আসলে তাদের দেবর এবং ভাসুরদের সাথে পর্দা/হিজাব করে চলতে হবে; যেটা এক ভিটায় থাকলে কখনোই সম্ভব না।
তাহলে সমাধান কি? সমাধান হল: যখন বুজুর্গ ‘ক’ এর প্রথম পুত্র ‘এ’ এর বিয়ে হবে, তখন তাকে পাশেই আলাদা ভিটা করে দিতে হবে। এরপর যখন দ্বিতীয় পুত্র ‘বি’ এর বিয়ে হবে, তখন তাকেও আলাদা করে দিতে হবে। তাহলে শুরু থেকেই ভাবী দেবরদের সাথে হিজাব করতে পারবেন। তবে তৃতীয় পু্ত্র অবশ্যই পিতা ‘ক’ এর সাথে থাকতে পারেন। এবং পিতা ‘ক’ অন্য যেকোন পুত্রের সাথে থাকতে পারেন। তবে তিন পুত্র পরিবার সহ কখনোই এক সাথে নয়। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, গ্রামাঞ্চলে সবাই এরকম ভাই-ভাই আলাদা হওয়াটাকে ঘৃণা করেন এবং এটাকে ইসলাম বিরোধিতা মনে করেন, এটা সুস্পষ্ট একটা ভুল ধারণা। আসলে এরকম একসাথে থাকাতে ইসলামে কোথাও বলা নাই। এরকম এক সাথে থাকাটা হল ‘ভারত উপমহাদেশীয়’ একটি হিন্দু কালচার। কারণ হিন্দু ধর্মে ফার্স্ট কাজিনদের মধ্য বিয়ে হারাম- তারা আপন ভাই বোন এর মতন। এজন্য এই কালচারটি শুধুই ভারত-পাক-বংগেই দেখা যায়, মুসলিম বিশ্বের অন্য জায়গায় দেখা যায়না। মুসলিম বিশ্বের অন্য জায়গায় বিয়ের সাথেই পুত্র্রকে আলাদা বাসা দিয়ে দেয়া হয়, যাতে ভাবী-দেবর-শাশুড়ী-ননদ ‘কাউয়াজ’ থেকে জাতি হেফাজতে থাকতে পারে। আরও একটা তথ্য দেই, দেওবন্দী বুজুর্গ থানবী (রহ) কিন্তু তার বেহেশতী জেওরে বিয়ের পরে এই রকম আলাদা হওয়া সাপোর্ট করেছেন শক্তভাবে। তার মানেই এদেশীয় ‘আলেম’ দের পক্ষে এ ব্যাপারে সোচ্চার হতে কোন বাধাই নাই, বরং ইন্সপাইরেশন রয়েছে। কিন্তু কখনোই কোন আলেম ভুলেও এই ব্যাপারে জুমুআ’র খুতবায় বক্তব্য রাখেন না- এটা খুবই দুঃখ জনক।
কথা প্রসংগে এসে গেল, তাই আরও কয়েকটা ব্যাপার উল্লেখ করছি-
১. আপনার (আপনি পুরুষ হলে) চাচী- মামী – ভাবী – শালী এবং বিপরীতক্রমে (আপনি মেয়ে হলে) খালু-ফুপা-দুলাভাই-দেবর- এঁরা আপনার নন-মাহরাম। এঁদেরকে মা/বোন বা বাপ-ভাই এর সমতুল্য ভাবার কোন কারণ নাই। স্পর্শ করা, এবং হিজাব ছাড়া দেখা করা সম্পূর্ণ হারাম। [মনে করেন, আপনি বাড়ি থেকে বিদায় নিচ্ছেন, আপনার মামী/চাচী আপনার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে আপনাকে বিদায় দিচ্ছেন যা সুস্পষ্ট হারাম হবে, সাবধান থাকবেন।] আর দেবর-ভাবী, দুলাভাই-শালী নিয়া কিছু বললাম না: যার সিনসিয়ারিটি আছে সে বুঝে নিবে এবং দূরত্ব বজায় রাখবে, যার নাই, সে ত্যানা প্যাঁচাবে।
২. চাচাত-মামাত-খালাত-ফুফাত সব কাজিন ভাই এবং বোন, আপন ভাই বোন হিসেবে বিবেচিত নয়। মনে করুন আপনি একজন হিজাবী সিস্টার, আপনার তিন বছরের ছোট সাবালক ভাইকে আপনি আপন ছোট ভাই হিসেবে বিবেচনা করেন, এবং তার হাত কোন ঘটনা ক্রমে ধরলেন, বা এক রিক্সায় ঘুরলেন- এগুলা সম্পূর্ণ হারাম এবং আপনার হিজাব আসলে মাঠে মারা যায়নি, পানিতে ডুবে মারা গেছে। ‘ও তো বয়সে ছোট, ওর সাথে আবার কিসের পর্দা’ — এই সব লুতুপুতু কথা আল্লাহ গ্রহণ করবেন না। বয়স বিবেচ্য নয়, সাবালক হলে ১৫ বছরের ছোট খালাত ভাইর সাথে হিজাব করতে হবে। গ্রামাঞ্চলে ফার্স্ট কাজিনদের মধ্যে যিনা-ব্যাভিচারের (হুজুররা ব্যাপারটা জানেনা, তা কিন্তু মনে না করিয়েন) একটা ব্যাপক চল আছে, তাঁর কারন এইসব লুতুপুতু যুক্তি। মনে রাখবেন এভাবেই শুরু হয়।
৩. ছেলের এখনও দাড়ি মোচ উঠে নাই, ওর সাথে আবার কিসের পর্দা! এইটা হল আরেকটা অজ্ঞানতা জনিত যুক্তি। আসলে দাড়ি মোচ বালেগ হবারও একটু পরে উঠে, কারও কারও ক্ষেত্রে অনেক দেরী হতে পারে। তার মানে কিন্তু এই না যে ছেলেটি ‘কিছু বুঝে না’। আসলে ১০ বছর বয়স থেকেই [জি হ্যাঁ, ক্লাস ৫] ছেলেরা ‘সেক্সুয়াল ফিলিংস’ পেতে শুরু করে, ১২-১৪ বছরের মধ্যে কোন এক সময়ে বালেগ হয় গ্রীষ্মকালীন অঞ্চলে। (মানে বাংলাদেশে)। শরীয়াহর বালেগ হবার থ্রেশোল্ড যদিও ১৫ বছর, তবে এটা হল ম্যাক্সিমাম, মিনিমাম নয়। ১০ থেকে ১৫ বছরের যেকোন ছেলে নিশ্চিত ভাবেই কুরআনে বর্ণিত ‘নারী বিশেষ অংগ সম্পর্কে জ্ঞান রাখেনা’ – এর অন্তর্ভুক্ত নয়। যদিও আমি বহু দ্বীনদার মহিলাদের এই ব্যাপারে অজ্ঞানতা প্রসূত সীমা লংঘন করতে দেখেছি। এর কারণ এই সময় ছেলেরা মেন্টালি ম্যাচিউর হয় না বলে ‘আমি কিছুই বুঝিনা, আমি হাঁদারাম বৎস’ – এই রকম একটা ভাব নিয়া থাকে যদিও সে ফিজিক্যালি বালেগ হয়ে যায়, বা ‘ফিলিংস’ পেতে শুরু করে। তাই এই ব্যাপারে হিজাবী সিস্টারদের সাবধানতা জরুরী।
৪. ১০ বছরের উপরের কাজের ছেলেদের ব্যাপারে অবশ্যই সাবধানতা জরুরি। এদেরকে তো ১৯-২০ বছর পর্যন্ত নাবালক শিশু মনে করা হয় এবং অন্দর মহলে এদের অবাধ যাতায়াত থাকে। বেটার হল, যদি হিজাব করতে চান, ঘরের টুকটাক কাজ করার জন্য কাজের ছেলে না রেখে কাজের মেয়ে রাখুন; তাহলে কখন আবার বালেগ হয়ে যায়, এটা নিয়া টেনশন করতে হবে না।
পুনশ্চ ১: আপনার জীবন কঠিন করার জন্য এই লেখাটা লিখি নাই; যদি আপনি দ্বীন পালন করনেওয়ালা হন, তাহলে শুধু মনে করিয়ে দেয়ার জন্য এই লেখা দিয়েছি। সিনসিয়ার হলে আল্লাহ অবশ্যই আপনাকে সাহায্য করবেন এই ব্যাপারে দ্বীন পালন করার ক্ষেত্রে।
পুনশ্চ ২: শেষ কথা হল এই, এগুলো গ্রামাঞ্চলে বা শহরেও এক দিনে সমাধা হবার মতন ব্যাপার নয়, সময় লাগবে। তবে উলামায়ে কিরাম যদি উদ্যোগ নিয়ে জুমুআ’র খুতবায় এগুলা পয়েন্ট আউট করতেন, তাহলেই খুব দ্রুত এগুলো সমাধা হয়ে যেত। যদি কোন আলেম এই লেখা পড়ে থাকেন, তাহলে সেই উদ্যোগ নিবেন আশা করি।
পুনশ্চ ৩: আমার এই লেখাতে আমার অনেক নিজস্ব ‘জাজমেন্ট’ আছে, যা ভুল হতে পারে; ভুল হলে দলিল দিয়ে শুধরিয়ে দিবেন আশা করি। অনলি আল্লাহ নোউজ দ্য বেস্ট। কারা মাহরাম (এদের সাথে হিজাব না করলেও চলবে) এবং কারা নন-মাহরাম (এদের সাথে হিজাব করতেই হবে) তার একটা দলিল এখানে পাবেন।
লেখক - মোঃ রেজাউল করিম ভূঁইয়া
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন