জামা‘আতে শামিল হওয়ার গুরুত্ব !!!
তাবেঈ ওবায়দুল্লাহ ইবনু আব্দিল্লাহ (রাঃ) বলেন, একদা আমি আয়েশা (রাঃ)-এর নিকট গিয়ে বললাম, আপনি কি আমাকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মৃত্যুর রোগ সম্পর্কে কিছু বর্ণনা করবেন না? তিনি বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই করব। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর রোগ যখন গুরুতর আকার ধারণ করল, তখন তিনি একবার বললেন, লোকেরা কি ছালাত আদায় করে ফেলেছে? আমরা বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! না, তারা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমার জন্য গামলায় (পাত্রে) পানি ঢাল। আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমরা পাত্রে পানি দিলে তিনি ওযূ করলেন এবং খুব কষ্ট করে দাঁড়াতে চাইলেন; কিন্তু অজ্ঞান হয়ে গেলেন। অতঃপর জ্ঞান ফিরে এলে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, লোকেরা কি ছালাত আদায় করে ফেলেছে? আমরা বললাম, না, তারা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আমার জন্য পাত্রে পানি ঢাল। আয়েশা (রাঃ) বলেন, তিনি উঠে বসলেন এবং ওযূ করলেন। অতঃপর দাড়াঁতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু আবার অজ্ঞান হয়ে গেলেন।জ্ঞান ফিরে আসলে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, লোকেরা কি ছালাত আদায় করেছে? আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! না, তারা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। তিনি আবার বললেন, আমার জন্য পাত্রে পানি ঢাল। তিনি উঠে বসলেন এবং তৃতীয়বার ওযূ করলেন। অতঃপর দাড়াঁতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু এবারও অজ্ঞান হয়ে গেলেন। অতঃপর জ্ঞান ফিরলে তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, লোকেরা কি ছালাত আদায় করেছে? আমরা বললাম, না ,তারা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে ।
আয়েশা (রাঃ) বলেন, লোকেরা তখন এশার ছালাতের জন্য রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অপেক্ষায় মসজিদে অবস্থান করছিলেন। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবুবকর (রাঃ)-এর নিকট এই সংবাদসহ লোক পাঠালেন যে, তিনি যেন লোকদের ছালাত পড়িয়ে দেন। বার্তাবাহক আবুবকরের নিকটে পৌছে বলল, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনাকে লোকদের ছালাত পড়িয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, আবুবকর (রাঃ) একজন কোমল হৃদয়ের ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বললেন, হে ওমর! আপনি লোকদের ছালাতের ইমামতি করুন। ওমর (রাঃ) বললেন, আপনিই এর জন্য অধিকতর যোগ্য। আয়েশা (রাঃ) বলেন, আবুবকরই সেই কয়দিনের ছালাতে ইমামতি করেছিলেন। অতঃপর একদিন নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিছুটা সুস্থতা বোধ করলেন এবং দুই ব্যক্তির সাহায্যে যোহরের ছালাতের জন্য বের হ‘লেন । যাদের মধ্যে একজন ছিলেন আব্বাস (রাঃ)। আর তখন আবুবকর লোকদের ছালাত পড়াচ্ছিলেন। আবুবকর (রাঃ) যখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে দেখলেন, তখন পিছনে সরে যেতে উদ্যত হ‘লেন। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে পিছনে সরে না আসতে ইশারা করলেন। আর সাথীদ্বয়কে বললেন, আমাকে আবু বকরের পাশে বসাও । সুতরাং তারা তাঁকে পাশে বসালেন এবং তিনি বসে থাকলেন, দাড়াঁতে পারলেন না ।
রাবী ওবায়দুল্লাহ ইবনু আব্দিল্লাহ বলেন, একবার আমি আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ)-এর নিকট গিয়ে তাঁকে বললাম, আয়েশা (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ইন্তিকালের রোগ সম্পর্কে আমাকে যে বিবরণ দান করেছেন, তা কি আপনার নিকট পেশ করব না? তিনি বললেন, করুন।অতঃপর আমি তাঁর নিকট আয়েশার বিবৃত বিবরণ পেশ করলাম। তিনি তার কোন অংশই অস্বীকার করলেন না।শুধু একথাই জিজ্ঞেস করলেন, যে আব্বাসের সাথে ছিলেন আয়েশা (রাঃ) কি তাঁর নাম বলেছেন? আমি বললাম, না ।তিনি বললেন, সে ব্যক্তি ছিলেন আলী (রাঃ) ।১
অপর বর্ণনায় রয়েছে, রাসূল (সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর রোগ বেড়ে গেলে একবার বেলাল তাঁকে ছালাতের সংবাদ দিতে আসলেন।রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বেলাল (রাঃ)-কে বললেন, আবুবকরকে বল, মানুষের ছালাত পড়িয়ে দিতে।ফলে আবুবকর সে কয়দিনের ছালাত পড়িয়েছিলেন।অতঃপর একদিন নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কিছুটা সুস্থতা বোধ করলেন এবং দুই ব্যক্তির কাঁধে ভর দিয়ে মাটিতে পা হেচড়াঁতে হেচড়াঁতে মসজিদে প্রবেশ করলেন।যখন আবুবকর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পদধ্বনি শুনতে পেলেন তখন পিছনে সরতে উদ্যত হ‘লেন ।কিন্তু রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে সরে না যাওয়ার জন্য ইঙ্গিত করলেন ।অতঃপর তিনি অগ্রসর হয়ে আবুবকরের বাম দিকে বসে গেলেন ।তখন আবুবকর দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করতে লাগলেন।আর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বসে ইমামরূপে ছালাত পড়তে থাকলেন।আবু বকর (রাঃ) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ছালাতের ইক্বতেদা করলেন এবং লোকেরা আবু বকরের ছালাতের অনুসরণ করলেন।২
অন্য হাদীছে ফরয ছালাতের জামা‘আতে শরীক হওয়ার ব্যাপারে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কঠোর হুঁশিয়ারী রয়েছে।আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আল্লাহ্র কসম! আমার ইচ্ছা হয় কিছু লাকড়ি একত্র করার নির্দেশ দেই এবং তা একত্র করা হ‘লে ছালাতের আযান দিতে আদেশ করি।আর আযান দেওয়া হ‘লে আমি কাউকে হুকুম দেই লোকদের ইমামতি করতে,আর আমি সে সকল লোকের বাড়ী বাড়ী যাই যারা জামা‘আতে উপস্থিত হয়নি এবং তাদের সহ তাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেই।সেই আল্লাহ্র কসম! যার হাতে আমার জীবন রয়েছে! যদি তাদের কেউ একটা গোশতওয়ালা হাড়ের অথবা দুইটা ভাল কুরের খবর পেত তাহ‘লে নিশ্চয়ই এশার ছালাতে হাযির হ’ত’ ।৩
জামা‘আতে শরীক হওয়ার ব্যাপারে কোন অন্ধ ব্যক্তিকেও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছাড় দেননি।যেমন- আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকট এক অন্ধ ব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! আমার এমন লোক নেই যে আমাকে হাত ধরে মসজিদের দিকে নিয়ে যাবে । (অর্থাৎ লোকটি রাসূলের নিকট ঘরে ছালাত আদায়ের অনুমতি চাইল)।রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে অনুমতি দিলেন।কিন্তু সে যখন উঠে গেল তখন তিনি তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি ছালাতের আযান শুনতে পাও? সে বলল, হ্যাঁ ।রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তখন বললেন, তবে মসজিদে উপস্থিত হওয়া তোমার জন্য আবশ্যক’ ।৪
শিক্ষাঃ
১. অসুস্থ থাকলেও জামা‘আতে উপস্থিত হওয়া উত্তম ।
২. অন্ধ ব্যক্তিকেও মসজিদে উপস্থিত হ‘তে হবে ।
৩. ইমাম আসবে এটা বুঝা গেলে ইমামের জন্য অপেক্ষা করা যায় ।
৪. যোগ্য ব্যক্তিকে ছালাতের ইমামতির দায়িত্ব দিতে হবে ।
৫. আবুবকর (রাঃ)-ই রাসূলের পরে খলিফা হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে ।
নোটঃ ছালাতের জামা‘আতে উপস্থিত হ‘তে পারলে ২৭ গুণ বেশি ছওয়াব পাওয়া যায় ।৫যে তিনটি কারণে জামা‘আতে অনুপস্থিত থাকা যায় -১. অসুস্থতা ২. শত্রুর ভয় ৩. ঝড়- বৃষ্টি ।৬
*আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ।
তথ্যসূত্র :
১. বুখারী হা/৬৪৬; মুসলিম হা/৬২৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১০৭৯ ।
২. বুখারী হা/৬০৮; মুসলিম হা/১০৪১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১০৭২ ।
৩. মুসলিম হা/১০৪৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৯৮৬
৪. মুসলিম; মিশকাত হা/১০৫৪ ।
৫. বুখারী হা/৬০৯; মুসলিম হা/১০৩৮; মিশকাত হা/৯৮৫ ।
৬. বুখারী হা/৬২৬; মুসলিম হা/১১২৫; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৯৮৮; মুসলিম হা/১০৪৫; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১০০৫; আবু দাঊদ হা/৪৬৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা ১০০১ ।
রচনায় : হাফেয মুকাররাম বিন মুহসিন*
অনুলিখন : মুহাম্মাদ আলীমুদ্দিন
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন